পুলিশের চাকরির জন্য কত টাকা লাগে?

“শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা ও প্রগতি” এই স্লোগানকে ধারণ করে বাংলাদেশ পুলিশ দেশের অভ্যন্তরে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, দাঙ্গা হাঙ্গামা ইত্যাদি সহ সকল সমাজ বিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। এই উপমহাদেশে পুলিশ বাহিনীর এক গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকে রাখায় ইতিহাসে পাতায় বাংলাদেশ পুলিশের নাম স্বর্নাক্ষরে লিখা রয়েছে। তবে কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকান্ড এবং দুর্নীতির জন্য বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশকে দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঁকা চোখে দেখেন। আর এর প্রভাবে পরে পুলিশের চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রেও। তাই যারা বাংলাদেশ পুলিশে যোগদানের ইচ্ছা পোষণ করেন তাদের অনেকরই সর্ব প্রথম যে প্রশ্নটি মাথায় আসে তা হলো ‘পুলিশের চাকরির জন্য কত টাকা লাগে?‘ আদেও কি টাকা ছাড়া পুলিশে চাকরি হয়?

পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান বা সেক্টরের-ই ভালো মন্দ দুই দিকই রয়েছে। কোন ক্ষেত্রে ভালোর পরিমান বেশি আবার কোন ক্ষেত্রে মন্দের বা খারাপের পরিমান বেশি। কোন প্রতিষ্ঠানই সমালোচনার উর্ধে নয়। বাংলাদেশ পুলিশও তেমনি সমালোচনার উর্ধে নয়। এখানেও যেমন অসংখ্যা ভালো ব্যক্তি রয়েছে তেমনি খারাপ ব্যক্তিও কর্মরত রয়েছে। আর স্বভাবগত ভাবেই উপমহাদেশের লোকজন একটু বেশি লোভী প্রকৃতির হয়ে থাকে। যার প্রভাব বাংলাদেশ পুলিশেও বিদ্যামান। তাই বলে খারাপ, দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু লোকের জন্য জন্য সমগ্র পুলিশ বাহিনীকে খারাপ বা দুর্নীতিগ্রস্থ বলাটা অযোক্তিক। আর পুলিশে যোগদান করতে টাকা লাগবেই এমন ভাবাটাও বোকামি।

আমরা এই আর্টিকেলে পুলিশে যোগ টাকা লাগে নাকি লাগেনা এই বিষয়টি বাস্তবতার আলোকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো। তাই আপনি যদি বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দানে আগ্রহী হোন এবং বাংলাদেশ পুলিশের সামনের নিয়োগ মাঠে যোগদান করবেন বলে চিন্তা করে থাকেন তাহলে এই পোস্টটি শুধু মাত্র আপনারই জন্য। ইনশাল্লাহ এই আর্টিকেলটি আপনার অনেক ভুল ধরণা ভাঙ্গতে সক্ষম হবে।

আরও পড়ুন :

বাংলাদেশ পুলিশের নিয়োগ প্রক্রিয়া :

বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর নিয়োগ পক্রিয়া অন্যান্য সরকারি চাকরির চেয়ে কিছুটা আলাদা। অন্যান্য সরকারি চাকরিতে শারীরিক যোগ্যতা না দেখা হলেও পুলিশের চাকরিতে এটিই মুখ্য। তাই পুলিশের নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম এই দিকটিই দেখা হয়।বাংলাদেশ পুলিশ সাধারণত তিনটি স্তরে ৪ ক্যাটাগরীতে নিয়োগ দিয়ে থাকে।

  • এএসপি
  • সার্জেন্ট/এস আই 
  • পুলিশ কনস্টেবল

পুলিশের চাকরিতে কত টাকা লাগে সেটা ভালোভাবে বুঝতে হলে আগে আমাদের পুলিশের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে হবে তাহলে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারবো টাকা দিয়ে চাকরি নেওয়ার বিষয়টি সঠিক কিনা।

আরও পড়ুন : আধুনিক বাংলা সিভি লেখার নিয়ম | সর্বশেষ নিয়মানুসারে

পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ :

সাধারনত বাংলাদেশ পুলিশের নিয়োগের সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে, পুলিশ কনষ্টেবল। এবং নিয়োগের সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে এএসপি। একজন মাধ্যমিক বা সমমান পাশ শারীরিক যোগ্যতা সম্পন্ন প্রার্থী সরাসরি পুলিশ কনষ্টেবল পদে যোগদান করতে পারেন। এই ক্ষেত্রে একজন প্রার্থীকে সর্বপ্রথম পুলিশ কনষ্টেবল পদে  আবেদন করতে হয়।

এরপর আবেদনকৃত প্রার্থীদের নির্দিষ্ট দিনে মাঠের জন্য ডাকা হয়। সেখানে সর্বপ্রথম শিরীরিক যোগ্যতা এবং কোন শারীরিক ত্রুটি আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করা হয়। 

শারীরিক যোগ্যতা এবং ত্রুটি মুক্ত প্রার্থীদের দৌড়, লং জাম্প, পুশ আপ ইত্যাদির মত কিছু ইভেন্ট অর্থাৎ ফিজিক্যাল এন্ডুরেন্স টেস্ট সম্পূর্ণ করে নেওয়া হয়। ফিজিক্যাল এন্ডুরেন্স টেস্টে সফল ভাবে উত্তীর্ন প্রার্থীদের এরপর একদম প্রথমিক পর্যায়ের বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সাধারণ জ্ঞানের উপর একটি লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়।

লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ন প্রার্থীদের পরবর্তীতে প্রথমিক মেডিকেল এবং ভাইভার পর একজন প্রার্থীকে পুলিশ কনষ্টেবল নিয়োগের জন্য চূড়ান্ত ভাবে মনোনীত করা হয়।

এস আই / সার্জেন্ট নিয়োগ :

স্নাতক বা সমমান পাশ শিক্ষার্থীগণ সার্জেন্ট/এস আই পদের জন্য আবেদন করতে পারেন। আবেদন কৃত প্রার্থীদের উচ্চতা ও সব গুলো শিক্ষাগত যোগ্যতার উপর ভিত্তি করে একটি নিদিষ্ট সংখ্যাক প্রার্থীদের প্রাথমিক ভাবে ফিজিক্যাল এন্ডুরেন্স টেস্টের জন্য নির্বাচন করা হয়।

এবং তাদেরকে ৩ দিন ব্যাপি ফিজিক্যাল এন্ডুরেন্স টেস্টের জন্য ডাকা হয়। অতঃপর ফিজিক্যাল এন্ডুরেন্স টেস্টে উত্তীর্ন প্রার্থীদের বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান, গণিত ও মনস্তত্ব বিষয়ে ২৫০ মার্কের একটি লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়। এরপর উত্তীর্ন প্রার্থীদের ভাইভা ও পুলিশ ভেরিফিকেশণের পর সার্জেন্ট/এস আই পদে যোগদান করানো হয়।

ASP নিয়োগ :

এএসপি পদে যোগ দানের ক্ষেত্রে বিসিএস পরীক্ষার, প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভাতে উত্তীর্ন হতে হয়। তবে বিসিএসে উত্তীর্ন হলেই কেউ এএসপি পদে যোগদান করতে পারেন না। এএসপি পদে সুপারিশ প্রাপ্ত হওয়ার জন্য অবশই মেধা তালিকার প্রথম দিকে থাকতে হয়। এবং নিদিষ্ট উচ্চতা সম্পন্ন হতে হয়।

এই হলো বাংলাদেশ পুলেশের সংক্ষিপ্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া। তবে এই তিন স্তরের নিয়োগের মধ্যে সার্জেন্ট/এস আই ও পুলিশ কনষ্টেবল পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেই মূলত আর্টিকেলের বিষয় বস্তু আলোচিত হয়।

আরও পড়ুন : পুলিশে চাকরির জন্য কি কি কাগজ লাগে

পুলিশের চাকরির জন্য কত টাকা লাগে?

পুলিশের চাকরিতে কত টাকা লাগে

উপরের আলোচনা হতে এতক্ষনে আপনারা আবগত হয়েছেন যে, বাংলাদেশ পুলিশের নিয়োগ সাধারনত তিনটি ধাপে হয়ে থাকে। পুলিশ কন্সটেবল পদে আবেদনে জন্য আবেদন ফি বাবদ ৪০/- টাকা। এসআই/সার্জেন্ট পদে আবেদনের জন্য আবেদন ফি বাবদ ৪০/- টাকা এবং বিসিএস পদে আবেদনের জন্য প্রয়োজন হয় ১০০০/- টাকা। 

তবে যেহেতু পুলিশের চাকরি তাই এর বাহিরে অপ্রাসঙ্গিক ভাবে আর একটি বিষয় চলে আসে সেটি হল পুলিশের চাকরি নিতে অর্থাৎ তদবিরের মাধ্যমে চাকরি নিতে কত টাকা লাগে।পুলিশে চাকরিতে যোগদান করতে টাকা লাগে এই প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি উঠে পুলিশ কনষ্টেবল পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে। কারণ সার্জেন্ট/এস আই এবং ASP পদে ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। তবে সার্জেন্ট/এস আই ১০ গ্রেড অর্থাৎ দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরি হলেও আমাদের সমাজে অনেকেরই ধারণা সার্জেন্ট/এস আই পদে চাকরি পেতে হলেও একটি মোটা অংকের টাকার প্রয়োজন হয়।

এই পোস্টে আমরা পুলিশ কনষ্টেবল পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে আসলেই কত টাকা লাগে? কোন প্রকার ঘুষ লাগে কিনা বা ঘুষ ছাড়া চাকরি হয় কিনা সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

আমরা উপরে আলোচনা করেছি যে, পুলিশ সহ সব ডিপার্টমেন্টেই ভালো খারাপ উভয় ধরণের কর্মকর্তা রয়েছে। যার কারণে নিয়োগের ক্ষত্রেও এর একটি স্পষ্ট প্রভাব লক্ষণীয়। বাংলাদেশে একসময় ধারণা করা হতো পুলিশ কনষ্টেবল পদে যোগদান করতে হলে অবশ্যই অবশ্যই একটি মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিতে হবে।

শুধু ধারণাই নয় একটা সময় ঘুষ ছাড়া পুলিশে চাকরি হওয়াটা ছিল বিরল ইতিহাস। আর সেখান থেকেই মূলত প্রান্তিক পর্যায়ে এই ধারণাটি দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে পুলিশে চাকরি করতে হলে ঘুষ লাগবেই।

তবে অতীতের তুলনায় বর্তমান পরিস্থিতি বেশ ভালো বললেই চলে। এখন ঘুষ ছাড়া পুলিশে চাকরি পাওয়াটা আর বিরল কোন ঘটনা হয়। লাস্ট কয়েকটি নিয়োগ যদি আপনি পর্যবেক্ষণ করেন তাহলে এই বিষয়টি আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। একটা সময় নিয়োগের ক্ষেত্রে লাগামহীন দুর্নীতি হলেও বর্তমানে সরকারের স্বদিচ্ছার কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া আগের তুলনায় অনেকটাই স্বচ্ছ হয়েছে।

তবে পুলিশের নিয়োগ পুরোপুরি দুর্নীতি মুক্ত হয়ে গেছে এমনটি বলাও মুশকিল। কারণ আমরা প্রথমেই বলেছি প্রতিটি সেক্টরে ভালো খারাপ দুই ধরনেরই লোক আছে।

সত্যিকার অর্থে পুলিশের চাকরির জন্য কত টাকা লাগে?

বাংলাদেশ পুলিশের কনষ্টেবল পদে নিয়োগে জন্য একটা সময় অবস্থা ভেদে অভিভাবকদের ৫-১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুনতে হয়েছে। এবং এতো টাকা দেওয়ার পরও চাকরির নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি। ফলে পুলিশের চাকরি করতে ইচ্ছুক অসংখ্যা প্রার্থী একসময় পুলিশের চাকরিতে আবেদনই করতেন না।

তবে সরকার এবং আইজিপি মহোদয়ের স্বদিচ্ছার কারণে বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি হলেও প্রান্তিক পর্যায়ে সচেতনতা এবং সঠিক তথ্যের অভাবে দালালদের দৌড়াত্ত এখনো কমেনি। ফলে এখনো পুলিশের নিয়োগের সময় গ্রামের সহজ সরল অভিভাবকদের ক্ষেত্র এবং অবস্থান ভেদে ৫-১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষের পিছনে ব্যয় করতে হয়।

তবে বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে নিয়োগ মাঠের পূর্বেই মাইকিং সহ বিভিন্ন ভাবে প্রচার প্রচারণা চালানো হয় যে, এখন থেকে পুলিশে যোগ দেওয়ার জন্য কোন টাকা ঘুষ দিতে হবে না। দালাল থেকে সাবধান থাকুন, ঘুষ দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। কেউ চাকরির জন্য দালালকে টাকা দিয়ে প্রতারিত হবেন না ইত্যাদি ইত্যাদি।

আপনি যদি এটিকে নেহাত প্রচারণা মনে করেন তাহলে ভুল করবেন। কারণ গত কয়েকটি নিয়োগে আবেদন ফি বাবদ ১২০ টাকা দিয়েই নিজের যোগ্যতা বলে অসংখ্যা ছেলে মেয়ে পুলিশ কনষ্টেবল পদে চাকরি পেয়েছে। তাদেরকে এই ১২০ টাকা ছাড়া আর কোন টাকা খরচ করতে হয়নি। কাউকে কোন প্রকার উপঢৌকন বা ঘুষ দিতে হয়নি। আপনি যদি একটু জাতীয় দৈনিক গুলো ঘাঁটাঘাঁটি করেন তাহলেই এই কথার সত্যতা পেয়ে যাবেন।

যোগ্যতার একটা আলাদা শক্তি রয়েছে। চাইলেই যোগ্য ব্যক্তিদের অবজ্ঞা করা যায় না। তাই আপনি যদি নিজেকে পুলিশ কনষ্টেবল পদে যোগদানের জন্য যোগ্য মনে করেন তাহলে অবশ্যই আপনার উচিত ১২০ টাকা দিয়ে পুলিশে আবেদন করা। যদি কপাল ভালো থাকে ইনশাল্লাহ আপনি কোন প্রকার ঘুষ ছাড়াই পুলিশে যোগদান করতে পারবেন।

তাই প্রচলিত কল্প কথা বা দালালের খপ্পরে না পরে নিজের যোগ্যতা বলে পুলিশ মাঠে দাঁড়িয়ে যান। আর প্রতিটি সিস্টেমের কিছু দুর্বল দিক থাকে তাই দুর্বল দিক দিয়ে চাকরি নেওয়ার চেষ্টা না করে নিজের যোগ্যতা দিয়ে চাকরি নেওয়ার চেষ্টা করুন।

শেষ কথা :

পুলিশের চাকরি সম্মান জনক চাকরি গুলোর মধ্যে একটি। তবে কিছু আসাধু লোকের জন্য এই বাহিনীর নিয়োগ প্রক্রিয়া আজ প্রশ্ন বিদ্ধ। তবে সরকার যেহেতু ঘুষ ছাড়াই চাকরি দিচ্ছে তাই ৫-১৫ লাখ টাকা দিয়ে চাকরি নেওয়াটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। আশা করি এই আলোচনায় পুলিশের চাকরির জন্য কত টাকা লাগে? সে সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছি।

Visited 279 times, 3 visit(s) today

Leave a Comment